দর্পণ কবীর ►
১৯৯১ সাল। নারায়ণগঞ্জ শহরে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আমরা কয়েকজন বন্ধু তরুণ লেখক ও সংগঠন হিসাবে সক্রিয়। বোস কেবিনে আড্ডা দিতে শিখেছি। রেল-লাইন থেকে বিভিন্ন রেষ্টুরেন্টে প্রতিদিন জমিয়ে আড্ডা দিতাম আমরা কয়েক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একদিন আমরা তিনবন্ধু আবিস্কার করলাম, আমরা তিনজন একটি মেয়েকে ভালবাসি, মানে মেয়েটিকে পছন্দ করি। মেয়েটি মঞ্চে যখন পারফর্ম করে, আমরা তিনজনই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকি। ওকে দেখলে হেসে হেসে কথা বলি। মেয়েটি ভীষণ ভদ্র, সুন্দরী ও সুশীল। ওর মুখোমুখি হলেই আমরা যেন কেমন কর্পূরের মত উড়তে থাকি। মেয়েটির প্রতি ভাললাগা গোপন থাকে না। আমরা তিন বন্ধু এ নিয়ে সমঝোতা বৈঠকে বসলাম। ধরে নিন আমি ক, একজন খ এবং আরেকজন গ। খ দেখতে খর্বকায় ও নানা বিবেচনায় ভীষণ নাজুক। গ-বেশ সুন্দর হলেও হিন্দু ধর্মাবলম্বী। আমি নিজে মেয়েটিকে ভালবাসার জন্য ভীষণরকম অযোগ্য। কিন্তু আমরা মেয়েটির প্রতি ‘নীরবে ভালবেসে যাও’ টাইপের প্রেমিক! সমঝোতা বৈঠকে এই বিষয়ে আমরা একমত হলাম যে, মেয়েটি যাকে রেসপন্স করবে, তার ভালবাসা স্বীকৃতি পাবে। যে, যার মত মেয়েটিকে ভালবেসে যাও। আমরা ভালবাসি চোখের দৃষ্টি দিয়ে মেয়েটিকে দেখি আর মনে মনে কথা-কবিতা আউরে যাই। আমি বন্ধু গ’কে বলি। তুই ভালবাসিস কেন? তুই তো হিন্দু? ও বলে, আমি ভালবাসিনা, মেয়েটি যদি আমাকে ভালবাসে, আমি কী করব?’
এবার বন্ধু খ’কে বলি,
‘তুই তো দেখতে ভীষণ অসুন্দর। তোকে তো মেয়েটি কোনকালেই পাত্তা দেবে না! তুই ওকে ভালবাসার সাহস পাস কী করে?’
খ গম্ভীর হয়ে উদাসী কণ্ঠে বলে,
‘এটা আমার রুচি ও সাহস। ভালই যদি বাসবো, তবে শহরের শ্রেষ্ঠ মেয়েটিকেই ভালবাসব। তোরা সুন্দর ও আমার সামাজিক অবস্থান দেখছিস, এটা তোদের ব্যাপার। আমি ভালবাসলে অতো হিসাব করবো কেন? ভালবাসলে হিসেব করতে নেই!’
‘মেয়েটি তোকে পাত্তা দিচ্ছে না জেনেও ভালবাসবি?’
‘ওটা মেয়েটির ইচ্ছা। আমি ওকে কখনও বলবও না যে, ওকে আমি ভালবাসি।’
‘তাহলে? প্রেম হবে কীভাবে?’
‘এটাও এক ধরনের প্রেম, বুঝলি? ভালবাসবি, কিন্তু বলবি না!’
কীরকম ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে কথাগুলো বলে বন্ধু খ। আমি বলি,
‘আমি তো ওকে দেখলে কেমন যেন হয়ে যাই, বন্ধু! ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি!’
আমার কথার জবাবে খ হেসে বলে,
‘তুই নিচু শ্রেণির প্রেমিক! খুব সাধারণ মানের। শোন, মেয়েদের কখনও ভালবাসার কথা বলে ফেলবি না!’
‘বললে কী হয়?’
‘মেয়েরা তখন অহংকারী হয়ে যায়। ভালবেসে দেখবি, মেয়েটিকে বোঝাবি, কিন্তু বলবি না। তখন মেয়েটি তোকে গুরুত্ব দেবে। আর যদি হ্যাংলোর মত বলে ফেলিস, তাহলে মেয়েটিকে শুধু অহংকারী হবার সুযোগ করে দিবি! এখন তোর ইচ্ছা, তুই কী করবি!’
বন্ধু খ আমার চেয়ে ভাল ছড়া ও কিশোর কবিতা লেখে। অসম্ভব ওর কণ্ঠ। গান গাইলে লোকজন জড়ো হয়ে যায়। ভাল আবৃত্তিও করে। ওর কথাবার্তায় আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। মেয়েটিকে পছন্দ করি, কিন্তু বলতে পারি না। ঐ সময় বন্ধু খ’র কথাগুলো সামনে চলে আসে। দু’বছর পেরিয়ে যায় মেয়েটিকে দেখে-দেখে। একদিন ঢাকার নয়াপল্টন এলাকায় মেয়েটিকে দেখে ওর রিকশা থামাই। মেয়েটি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। আরো পরিণত হয়েছে। দু’বান্ধবীকে নিয়ে রিকশার ওপরে বসে যাচ্ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। আমার ডাকে মেয়েটির চোখে খুশির দ্যুতিও দেখতে পাই। মনে মনে নিজেকে ঠিক করে ফেলেছিলাম, আজ ওকে বলে ফেলব নিজের ভাল লাগার কথা। মেয়েটিও কি এমন প্রত্যাশা করেছিল? জানি না। সেদিনও বলতে পারিনি। ঐদিনও বন্ধু খ’র কথাগুলো সামনে চলে এলো এবং দেয়াল হয়ে দাঁড়ালো। মেয়েটিকে অহংকারী হতে দিলাম না!
অনেক অ-নে-ক পর অবশ্য জানতে পারি, মেয়েটি ভালবেসেছিল অন্য এক যুবককে। ভালবেসে ওরা বিয়েও করেছে এবং সুখের সংসারও করছে। শুধু আমাদের তিন বন্ধুর ‘নীরবে ভালবেসে যাও’ মনের অনুরাগ সময়ের সঙ্গে হাওয়ায় মিশে গেছে। বন্ধু খ আমাদের মত সাধারণ ও সংসারী হয়নি। হয়েছে ভবঘুরে। এখন ও পথে-প্রান্তরে গান গায়-জল, নাকি ছল? চঞ্চল, মেয়ে তুই বল..!’