ইউরো ট্রেনে বাংলাদেশি পাসপোর্ট মানে ঘোর সন্দেহ

২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসে জার্মানী থেকে ইতালীর মিলানোতে যাচ্ছিলাম ইউরো ট্রেনে। সুইজারল্যান্ডের সীমান্তে একটি স্টেশনে ট্রেনটি ৫ মিনিটের জন্য থামলো। শুধু পাসপোর্ট শব্দ বুঝে নিজের পাসপোর্ট বের করে দিলাম। ঐ কর্মকর্তা আমার পাসপোর্ট নিয়ে কী যেন বলে চলে যেতে লাগলেন। আমি ভয়ে আঁতকে উঠলাম। কারণ, ৫ মিনিট দাঁড়াবে ট্রেন। যদি না ফেরে! বিদেশে পাসপোর্ট হাতছাড়া করতে নেই-এটা জেনে এসেছি। আমি চিৎকার করে বাংলায় গালিও দিলাম। যাত্রীরা আমাদের বাক্যালাপ দেখলো ও শুনলো শুধু। ঐ কর্মকর্তা চলে গেলে আমি টেনশনে ভুগছিলাম। ট্রেন ছাড়ার ১ মিনিট আগে অপর এক কর্মকর্তা এসে আমার পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিলে বিনীতভাবে ইংরেজীতে বললেন-যিনি পাসপোর্টটি নিয়েছিলেন, তিনি ইংরেজী জানতেন না। তোমার ভিসা চেক করেছি। ঠিক আছে। তোমাকে বিরক্ত করার জন্য আমরা দুঃখিত।শুধু পাসপোর্ট শব্দ বুঝে নিজের পাসপোর্ট বের করে দিলাম। ঐ কর্মকর্তা আমার পাসপোর্ট নিয়ে কী যেন বলে চলে যেতে লাগলেন। আমি ভয়ে আঁতকে উঠলাম। কারণ, ৫ মিনিট দাঁড়াবে ট্রেন। যদি না ফেরে! বিদেশে পাসপোর্ট হাতছাড়া করতে নেই-এটা জেনে এসেছি। আমি চিৎকার করে বাংলায় গালিও দিলাম। যাত্রীরা আমাদের বাক্যালাপ দেখলো ও শুনলো শুধু। ঐ কর্মকর্তা চলে গেলে আমি টেনশনে ভুগছিলাম। ট্রেন ছাড়ার ১ মিনিট আগে অপর এক কর্মকর্তা এসে আমার পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিলে বিনীতভাবে ইংরেজীতে বললেন-যিনি পাসপোর্টটি নিয়েছিলেন, তিনি ইংরেজী জানতেন না। তোমার ভিসা চেক করেছি। ঠিক আছে। তোমাকে বিরক্ত করার জন্য আমরা দুঃখিত।

২০০০ সালে মিলানো শহরে বৃষ্টিভেজা দিনে আমি

বুঝতে পারলাম। বাংলাদেশি পাসপোর্ট মানে ঘোরতর সন্দেহ। ফেরার পথেও (রোম থেকে প্যারিস ফিরছিলাম) ইউরো ট্রেনে ৮/৯জন বাংলাদেশি যুবকের সঙ্গে পরিচয় হলো। তারা ফ্রান্স-পর্তুগালসহ বিভিন্ন দেশে থাকেন। ইতালী ‘বৈধতা’ দেবে জেনে তারা গিয়েছিলেন ইতালী। তারা ইতালীতে বৈধতা লাভের আবেদনপত্র জমা দিয়ে নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরছিলেন। তাদের একজন আমাকে জানালো-ইউরো ট্রেনে টিটি (চেকার) এলে বুকের উপর পাসপোর্ট (থাকলে)সহ টিকেট রেখে ঘুমের অভিনয় করে সীটে শুয়ে থাকতে। টিটি ঘুমন্ত যাত্রীদের বিরক্ত করে না। টিটি এলো ওরা ঝটপট শুয়ে পড়লো। আমি ওদের বলিনি যে, আমি ট্যুরিষ্ট। আমিও ওদের মতো শুয়ে পড়লাম। ঠিকই-টিটি আমাদের দেখে না জাগিয়ে চলে গেল। টিটি চলে যেতেই সকলে উঠে বসলাম। আমরা হাসতে লাগলাম। এরপর ডাংকি (সীমান্ত অতিক্রম করা) নিয়ে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে গল্প শুনতে লাগলাম। প্যারিসে নেমে যে যার পথে, বিদায়!

জাপানী নয়, নেপালীদের পছন্দ বাংলাদেশি ট্যুরিষ্ট

১৯৯৯ সালে নেপালে গিয়েছিলাম সাংবাদিক হেলাল উদ্দিন এবং শামসুল আলম লিটনের সঙ্গে। স্থল পথে ভারত হয়ে নেপালের সড়ক পথ পাহাড়ি ও এতোটাই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল যে, ভয়ে আমরা ফিরেছিলাম আকাশ পথে। নেপালের পোখরা এলাকা টুরিষ্টদের উপস্থিতি বেশি। এখান থেকে নয়নাভিরাম কাঞ্চনজংঘা দেখা যায়। হিমালয়ের দীপ্তিময় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে খাকার অপূর্ব দৃশ্য এখান থেকে উপভোগ করা যায়। আমরা যে হোটেলে উঠেছিলাম-ওখানে আমাদের সামনে এক জাপানীকে ‘রুম নেই’ বলে বিদায় করে দিলেন ম্যানেজার দম্পত্তি। আমরা জানি, রুম আছে। জাপানী নাগরিক বিদায় হলে জানতে চাইলাম-কেন তাকে রুম ভাড়া দেয়া হলো না। নেপালী ম্যানেজার হাসিমুখে জানালেন-জাপানীসহ পশ্চিমারা এখানে এসে শুধু রাত্রিযাপন করে। ভোর হলেই চলে যায় পাহাড়ে। ওরা পাহাড়ে উঠতে পছন্দ করে। রাতে ফিরেও কিছু খায় না। কিন্তু বাংলাদেশিরা তিনবেলা খাবার খায়। খরচ করতেও উদার। তাই ওরা বাংলাদেশি ট্যুরিষ্ট পেলে খুশি হয়। কথাটা জেনে আমরা খুব আনন্দ পেলাম। শুধু নেপাল নয়, সিকিম, শিলিগুঁড়ি, দার্জিং, কলকাতায়ও দেখেছি বাংলাদেশি ট্যুরিষ্টদের খাতির করা হয় হোটেল-রেষ্টুরেন্টে।

অষ্ট্রেলিয়ায় দেখেছি বর্ণ বৈষম্য!

সবাই জানেন-বৃটেন থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে যারা অষ্ট্রেলিয়ায় (নিউজিল্যান্ডসহ) বসতি গড়েছে, তাদের নিয়েই অষ্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড নামক দুটি রাষ্ট্র। এই ভূ-খন্ডের প্রকৃত মালিক আদিবাসীরা। যুক্তরাষ্ট্রের মতো এ দুটি দেশেও আদিবাসীরা অবদমিত এবং সংখ্যালঘু। অষ্ট্রেলিয়ানরা

তাদের আচার-আচরণের কারণে ‘বর্ণ-বৈষম্য’-র অভিযোগ থেকে রেহাই পায়নি। সিডনী বিমানবন্দর নির্মাণ করতে হাজার হাজার আদিবাসীকে রাষ্ট্রীয় মদদে হত্যা করা হয়েছিল। যারা হত্যা করেছিল তাদের রাষ্ট্র থেকে পুরস্কারও দেয়া হয়েছিল। ঐ সময়ে কারাবান্দি দূর্ধর্ষ ডাকাত-খুনীদের ছেড়ে দেয়া হয়েছিল আদিবাসীদের হত্যা করার শর্তে। এর ডুকমন্টিরি অনলাইনে সার্চ করলেই পাওয়া যায়। সেই অস্ট্রেলিয়ায় যাবার দিন সিংগাপুরের চাংকি এয়ারপোর্টে (২০০১ সালে) আমার সবুজ পাসপোর্ট দেখেই সংশ্লিস্ট কর্মকর্তা উঠে কোথায় যেন চলে গেলেন। আমার পেছনে অনেক যাত্রী লাইনে। বিষয়টি আমাকে কেমন লজ্জায় ফেলে দিল। অস্বস্থি বোধ করছিলাম। একজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা এসে আমাকে প্রশ্ন করলেন-আমি সিডনী কেন যাচ্ছি। আমি হেসে বললাম-সিডনীতে তাসমান সমুদ্রে বড়শি ফেলে মাছ ধরতে চাই। আমার এই ইচ্ছাটা পূরণ করতে সিডনীতে যাচ্ছি। ঐ কর্মকর্তা হাসলেন এবং আমাকে বোর্ডিং পাস দিলেন।

সিডনীতে নামার পর আমাদের (এশিয়ার কিছু দেশের নাগরিক) জন্য অন্য লাইন। ওখানেও নানা প্রশ্ন-ব্যাগে তল্লাশী হলো। সিডনীতে ঘোরাঘুরি সময় লক্ষ্য করেছি-শ্বেত বর্ণের নাগরিকদের কেমন নাক উঁচু ভাব। দু’একজনের আচরণ রুষ্ট মনে হয়েছে। এর আগে আমি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেছি। অভিজ্ঞতার আলোকে অষ্ট্রেলিয়ানদের আচরণ বন্ধুসুলভ মনে হয়নি।

উল্লেখ্য, সিডনীর ব্লু-লেগুনে থ্রি সিষ্টার পাহাড় দেখেছিলাম। অনেক ট্যুরিষ্ট যায় ওখানে। এর আগে আমি কাছ থেকে হিমালয় দেখেছিলাম বলে ঐ পাহাড় আমাকে টানেনি। ফেরার পথে পাশের যাত্রী ছিল অস্ট্রেলিয়ান। প্রশ্ন করতে সে জানালো-সে যাচ্ছে কাঠমুণ্ডু-পাহাড় দেখতে। আমি মনে মনে হাসলাম।   

সিংগাপুরে অভিনয় করে এক পুলিশ অফিসারের বাসায় যেভাবে থেকেছিলাম..!

২০০১ সালে আমি সিংগাপুর যাবার সময় মনে হলো স্ত্রী-শিশু কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে যাই। হাতে যথেষ্ট টাকা ছিল না। নিজের মোটর সাইকেলটা বিক্রি করে দিলাম চ্যানেল আই-এর সাংবাদিক মোরছালীন বাবলার কাছে। এরপর সপরিবারে সিংগাপুর গেলাম। মাঝখানে একদিন বাংকক ছিলাম। সিংগাপুরে থাকতে গেলে হোটেল ভাড়াসহ সবকিছুতে খরচ বেশি। ওখানে নিজ এলাকার ব্যবসায়ীরা থাকেন বলে ভয় ছিল না। প্রথমদিন একটি বাসায় থাকার সুযোগ হলো। এরপর আমার স্নেহের (বন্ধুর ছোট ভাই) ছোট ভাই (ও এখন বেঁচে নেই) শাহীন বলল-ভাই একটা বুদ্ধি করলে বেশ কয়েকদিন এই শহরে থাকতে পারবেন। কী বুদ্ধি? ওরা ৩/৪জন ব্যবসায়ী এক চাইনিজ (ওখানে চাইনিজ, মালয় ও তামিল এই তিন জাতির বসবাস) পুলিশ অফিসারের বাসায় রাতে থাকে। রাতে ঐ পুলিশ অফিসার ডিউটি করেন। তিনি ভোরে বাসায় ফিরে নিজের কক্ষে থাকেন। ওরা সকালে বেরিয়ে যায়। মাস শেষে ভাড়া দেয় ওরা। সরকারি কোয়ার্টারে ওরা ছিল অবৈধ ভাড়াটিয়া! শাহীন বোঝালো-রাতে গিয়ে আমরা একটি রুমে থাকতে পারবো। কিন্তু ভোরে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে হবে।

ওরা পুলিশ অফিসারকে মিথ্যা এক গল্প বলে অনুমতি নেবে আমরা যেন থাকতে পারি। তার অনুমতি ছাড়া এ্যাপার্টম্যান্টে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না-এমন শর্ত ছিল। আমরা তাই করলাম। এ্যাপার্টমেন্টের ১৬ তলায় রাত কাটালাম। ভোর হতেই তড়িঘড়ি করে বাইরে চলে এলাম। ভেতরে আমাদের লাগেজ রয়ে গেল। ওরা ঐ পুলিশ অফিসারকে কী বলেছে-কে জানে। আমাদের একটি রুমে থাকার অনুমতি পাওয়া গেল। আমার স্ত্রী প্রতিদিন রান্না করে পুলিশ অফিসারকেও খেতে দেয়। ঝাল খাবার খেয়ে তার কী আনন্দ। বিরানী খেয়ে তো ঐ অফিসার প্রসংশায় পঞ্চমুখ। আমরা আরামে থাকি-মাস পেরিয়ে যায়। এ কদিনে ঐ পুলিশ অফিসার আমার স্ত্রীর রান্নার নানা রেসিপি লিখে নিয়েছে। ঢাকাইয়া খাবারের স্বাদের কারণে ঐ ব্যক্তি উল্টো আরো কিছুদিন থাকা যায় কিনা-অনুরোধ করেছিলেন। আমাদের ব্যবসায়ীরা (এলাকার ভাই) নিয়মিত ভাড়া দিত না-একদিন জানালেন ভদ্রলোক। এ কথা জানাতে গিয়ে তিনি কপট রাগ প্রকাশ করতেন। কিন্তু তার মনটা ছিল পিতার মত স্নেহ ও উদারতাপূর্ণ। দেশে ফিরে এসেছি। এরপর আরো অনেক ঘুরেছি। কিন্তু ঐ পুলিশ কর্মকর্তার স্নেহময় আন্তরিকতার কথা কখনও ভুলিনি। কে-জানে, তিনি বেঁচে আছেন কিনা।

বৃটেনকে ‘গরীব’ মনে হয়েছিল..!

২০০০ সালের নভেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রথম যেদিন লন্ডন যাই, হিথ্রো বিমান বন্দরে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা (পাকিস্তানী বংশদ্ভেূাত তরুণী) বিস্তর প্রশ্ন করেছিলেন। আমি অবাক হয়ে তাকে একসময় বলেছিলাম-আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছি..থাকতে হলে ওখানেই থাকতাম। যাই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া বৃটেনের চেয়ে অনেক ভালো। লন্ডনে ঝুপঝাপ বৃষ্টি নামে। এমন সপ্তাহ পার হয়-আকাশ মেঘলাই থাকে। এই শহরের নাগরিকরা প্রতিদিন ছাতা নিয়ে বের হন। লন্ডনের আবহাওয়া আমার ভাল লাগেনি। আমি উঠেছিলাম বন্ধু খাজা মাসুদের বাসায় (ব্যারিস্টার খাজা ওয়ালিউল্লা মাসুদ)। বন্ধু তখন ব্যারিস্টার হতে লেখাপড়া করছিল। ও প্রথমদিন আমাকে বলেছিল-দোস্ত, ঘরের সবরুমের লাইট জ্বালিয়ে রাখবি না। যে রুমে থাকবি, শুধু ঐ রুমের লাইট জ্বালাবি।’ ‘কেন’ বলার পর ও জানিয়েছিল-লন্ডনে বিদ্যুৎ খরচ অনেক বেশি। তাই সকলকে সাশ্রয়ী হতে হয়। আমি দেখতাম, মাসুদ মাঝেমাঝে নিচে  নেমে দোকান থেকে বিদ্যুতের জন্য কার্ড রি-চার্চ করে আসতো। একজন ছাত্র দৈনন্দিন খরচের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে-এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি মাত্র যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরেছি। সেখানে বিদ্যুত দেদারছে ব্যবহার হয়। কারো কোন কার্পণ্য দেখিনি। রাতের বেলায় বড় বড় বাণিজ্যিক অট্টালিকা আলোয় উদ্ভাসিত থাকে। আলো জ্বলমলে নিউইয়র্ক শহর আমার মনে দাগ কেটে দিয়েছে। 

তাই লন্ডনের প্রতি আকর্ষণবোধ করিনি। ২০০১ সালে দ্বিতীয়বার স্ত্রী-শিশু কন্যা নিয়ে যখন লন্ডনে যাই, (এক সময়ের কলিগ) সাংবাদিক কামাল হাসান বৃটেনে থেকে যেতে বলেছিলেন। বৃটেনে থাকলে এবং বৈধতা লাভ করলে অনেক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। সাংবাদিক হিসাবে আমাদের বৈধতা পাওয়া কঠিন ছিল না। কিন্তু নিউইয়র্ক আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল যেন। প্রথম ভ্রমণের সময় বৃটেনকে ‘গরীব’ ভেবে বসে আছি। তাই লন্ডনে কী করে থাকার কথা ভাবি?

প্যারিসে নেমে ভেবেছিলাম বিনা ভাড়ায় বাস-ট্রেনে চড়া যায় !

২০০০ সালে লন্ডন থেকে প্রথম প্যারিসে যাই। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া বাস টার্মিনাল থেকে বন্ধু খাজা মাসুদ (বর্তমানে ব্যারিস্টার) আমাকে বাসে তুলে দিল। প্যারিসে উঠবো বন্ধু আনিসের (ও জার্মানীতে থাকে) বন্ধু শফিকের (বর্তমানে বৃটেনে থাকেন) বাসায়। আমার সঙ্গে তার দেখা হয়নি। ফোনে কথা বলে রওনা দিলাম প্যারিস। বলা হয়নি-বাসে যাচ্ছি প্যারিস। বাস থেকে নামার পর কাউকে দেখতে পেলাম না। ডিসেম্বরের সন্ধ্যার বৃষ্টিমুখর প্যারিস বড্ড নির্জন ছিল। নিউইয়র্ক-লন্ডন থেকে গিয়ে ঐ সন্ধ্যার প্যারিসকে ভূতুরে মনে হচ্ছিলো। আমি ডলার ভাঙিয়ে কয়েন ব্যবহার করে রাস্তার টেলিফোন বুথ থেকে শফিক ভাইয়ের বাসায় ফোন করলাম । শফিক থাকতেন বোনের বাসায়। তার বোন (নামটা ভুলে গেছি-কাপাসিয়ার বকুল ভাইয়ের স্ত্রী-শিরিন আপা কি?) জানালেন-শফিক আমাকে বরণ করতে গিয়েছেন ইউরো ট্রেন স্টেশনে। আমি তো সস্তায় বাসের টিকেট ক্রয় করেছিলাম। কী আর করা, শফিক ভাইয়ের বোন টেলিফোনে আমাকে নির্দেশনা দিলেন কীভাবে ট্রেন ও বাস ধরে বাসায় আসতে হবে। তাদের বাড়ি ছিল প্যারিস শহরের বাইরে প্যাসোসিয়েট নামের একটি উপ-শহরে। অনেক দূর। আমি বাস স্টেশনের পাশের ট্রেন স্টেশনে গিয়ে তাকিয়ে দেখলাম যাত্রীরা কীভাবে ট্রেন ধরছেন। কাউকেই টিকেট কাটতে দেখলাম না। 

তাই মনে হলো-প্যারিসে হয়তো বিনা ভাড়ায় ট্রেনে চড়া যায়। আমি চড়লাম ট্রেনে। ট্রেনে চেকারে (টিটি) উঠে ৪/৫জন। তারা যাত্রীদের টিকেট আছে কিনা-চেক করেন। না থাকলে ফাইন করে চিঠি ধরিয়ে দেন। আমি তা জানতাম না। আমি ঐ চেকারদের দেখে কাছে গিয়ে শফিক ভাইয়ের বাড়ির ঠিকানা দেখিয়ে জানতে চাইলাম-কীভাবে যেতে পারি? তারা বললেন-সামনে গার্দো নর্থ স্টেশন থেকে অন্য ট্রেন ধরতে হবে। এরপর বাস ধরতে হবে। গার্দো নর্থ স্টেশন থেকে আরেকটি ট্রেন ধরে অন্য এক স্টেশনে নেমে বাস ধরতে গিয়েও লক্ষ্য করলাম-কেউ টিকেট কাটছে না। আমিও বাসে চড়লাম। এরমধ্যে আরো কয়েকজেন ফরাসী নাগরিকের সঙ্গে ইংরেজীতে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। তারা কেউ কথা বলেননি। হয়তো ইংরেজী জানেন না। বাস চালক ইংরেজীতে কথা বললেন। তিনি নামিয়ে দিলেন যথাযথ স্টেপিজে। শফিক ভাই বাসায় ফোন করে (তার সেলফোন ছিল না) আমার কথা জেনে ট্রেন স্টেশন থেকে বাড়িমুখি হয়েছিলেন। তার সঙ্গে দেখা হলো বাড়ির কাছাকাছি-পথে। ভয়ের মধ্যে ছিলাম। ভয় দূর হলো। পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে আমি বললাম-প্যারিস শহরে ট্রেন-বাসের টিকেট লাগে না-এটা খুব ভাল লেগেছে। আমার কথা শুনে বকুল ভাই, শফিক ভাই ও তার বোন খুব হাসলেন। বকুল ভাই জানালেন-প্যারিসে প্রায় সকলে মাসিক বা সাপ্তাহিক টিকেট কেটে ট্রেন-বাসে চড়ে। আমি বুঝতে পারলাম-ভুল অনুমান করে কী ভুল পদক্ষেপই না নিয়েছিলাম। ভাগ্যিস, চেকাররা আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেননি!

বকুল ভাই ঐদিন আমাকে বেশ কিছু টিকেট কিনে দিয়েছিলেন। আমি আর শফিক প্রতিদিন আড্ডা মারতে যাই গার্দো নর্থ এলাকায়। দেখি-শফিক ভাই টিকেট না কেটে ট্রেনে চড়েন। আমি কয়েকদিন টিকেট ব্যবহার করলাম। এরপর শফিক ভাইয়ের পথ ধরলাম। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ট্রেনে ছোটবেলায় টিটি দেখে অন্য কামরায় উঠতাম। পরের স্টেশনে আবার নামতাম। টিটি কোন কামরায় উঠে-দেখে অন্যটাতে উঠতাম। তালিম আগেরই ছিল। সেটা প্যারিসে ঝলসে নিয়েছিলাম। পরে ইতালীর রোমেও করেছি-অন্য কৌশলে। জার্মানীতে করা যায়নি। সেখানে চেকাররা যাত্রীবেশে ট্রেন-বাসে উঠেন। হা হা হা। স্মৃতি বটে!       

তাসখন্দে ৩ ডলার বকশিস দিতেই জড়িয়ে ধরলো তরুণী !

২০০২ সালে ঠিক করলাম, এবার পূর্ব দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাবো। সব সময় পশ্চিম দিক দিয়ে যাই। এতে মাটি স্পর্শ না করলেও অন্তত আকাশ পথে পৃথিবীকে চক্কর দেয়া হবে। এয়ারটিকেট কিনলাম ওজবেকিস্তান এয়ারলাইন্সের। রাজধানী তাসকন্দে একদিনের যাত্রা বিরতি। ওজবেক এয়ারলাইন্স বিনামূল্যে হোটেল কক্ষ দিয়েছিল। ১১টি পরিবার যাচ্ছিলাম নিউইয়র্ক। ভেবেছিলাম, ১০০ ডলার খরচ করবো ওখানে। ২০ ডলার ভাঙাতেই টাকার বস্তা পেলাম যেন। টাকা খরচ করি শেষ হতে চায় না। সবকিছু সস্তা। তাসকন্দ শহরে জাঁকজমক-জৌলুষ নেই। অবকাঠামোগত উন্নয়ন আছে, যেমন বাড়ি-বিদ্যুত-রাস্তাঘাট ঠিকঠাক। কমিউনিজমের পতনের পর রাষ্ট্রটি তখনও মস্কোমুখি ছিল। একদিনে যাদের সঙ্গে কথা বলেছি-মনে হচ্ছিলো ওদের কাছে পৃথিবীর বড় শহর ও অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে-মস্কো। নাগরিকদের শিক্ষার হার ১০০%। অথচ বিশ্বের খবরাখবর তেমন রাখে বলে মনে হল না। যাদের অর্থ আছে-তারা দাঁতে গোল্ডেন প্রলেপ লাগায়। হাসলো ঝিলিক মারে। আমরা ২৪/২৫ জনের একটি টিম ঘুরে বেড়ালাম। রাষ্ট্রপতির বাড়ি যা দেখলাম, এরচেয়ে বিলাসবহুল বাড়ি বাংলাদেশের সামান্য ধনী ব্যবসায়ীদের রয়েছে। রাষ্ট্রপতির বাড়ির সামনে কোন পাহারা নেই। মানুষজন তেমন চোখে পড়লো না।

রাতে হোটেলের নিকটস্থ রেষ্টুরেন্টে ডিনার করবো বলে গিয়েছিলাম। ডিনার করতে গিয়ে দেখি-ইংরেজী জানা এক তরুণীকে আনা হয়েছে আমাদের জন্য। তরুণীকে আমি (টীম লীডার হিসাবে) খাবারের অর্ডার দিলাম সবার জন্য। ওখানে বিভিন্ন প্রকার রুটি ও মাংশ পাওয়া যায়। আমরা ডিনার শেষ করার সময় একটি শিশু একটি গ্লাস ভেঙে ফেললো। তরুণী যেন ভয়ে কাঠ হয়ে গেলেন। আমার সামনে এসে দু’চোখ বড় বড় করে বলল,

‘মাই ফ্রেন্ড, দিস ইজ তাসকেন্দ! ভেরি এক্সপেন্সিভ!’

কথাটা বারবার বলে বোঝাতে চাইছিল গ্লাসটির দাম অনেক বেশি। আমি বিল দেয়ার সময় গ্লাসের দাম (বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ৬০ টাকা) পরিশোধ করলাম। একইসঙ্গে ৩ ডলার সমতূল্যের অর্থ তরুণীকে বকশিস দিলাম। এটি যেন তরুণী বিশ্বাস করতে পারছিল না। তরুণী আনন্দের অতিশয্যে আমাকে ঝাপটে ধরলো, মানে আলিঙ্গন করলো।

আমি হচকিয়ে গেলাম। আমার স্ত্রী কটমট চোখে দৃশ্যটি দেখলো। আমি তখন ভাবছিলাম, আগেরদিন এয়ারপোর্টে ব্যাগ টেনে দেয়ায় একজনকে ৫ ডলার বকশিস দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম-১০ ডলার দিলে হয়তো ভাল হতো। ৩ ডলার দিয়ে যে আনন্দ দেখলাম-এতে ৫ ডলার দেয়ার অস্বস্থি মিলিয়ে গেল।  

জার্মানীতে ২০০০ সালের নভেম্বর

জার্মানীতে ২০০০ সালের নভেম্বর গিয়েছিলাম ইউরো রেলে চড়ে। জার্মানীর কোলন শহরের পাশে গেলসেনক্রিশান এলাকায় বন্ধু আনিস এসেছিল আমাকে বরণ করতে। ওই শহরে বাস করেছিলাম ওর সঙ্গে।   

সিকিম গিয়েছিলাম ১৯৯৯ সালে

সিকিম গিয়েছিলাম ১৯৯৯ সালে। সিকিমের রাজধানী গ্যাংক থেকে খোলা জীপে চড়ে পাহাড়ী উপত্যকা সাংগুলেকে (১৩ হাজার ফুট উপরে) গিয়েছিলাম। এটি হিমালয় পর্বতের পাদদেশ বলা হয়। স্থলপথে এতো উপরে জীবনে কখনও উঠিনি। শ্বাসরুদ্ধকর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম। ভাবলে, এখনও ভয়ে গা শিরশির করে।