দর্পণ কবীর ♦
কিংবদন্তি অভিনেতা ও আবৃত্তিশিল্পী বাংলা চলচ্চিত্রের বরপুত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ৮৬ বয়সে চলে গেছেন ইহলোক ত্যাগ করে ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যয়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র জগতের দিকপালের বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ জানার পরপরই আমার কাছে মনে হয়েছিল-সৌমিত্র নেই, যেন বসন্ত নেই! তিনি আমার ২০টি কবিতা তাঁর জাদুকরী কণ্ঠে আবৃত্তি করেছিলেন। আর এতে আমার ‘কবি’ হওয়া পরিচিতি যেন অন্ধকারের আড়াল থেকে আলোর সুড়ুঙ্গ পেয়ে যায়। কীভাবে তাঁর কাছে আমার কবিতা পৌঁছুলো এবং তিনি আবৃত্তি করেছিলেন, সে কথা তুলে ধরছি।
২০১৬ সালে কলকাতায় আমি গান লিখে পাঠাচ্ছিলাম আর সঙ্গীত পরিচালক কুন্দন সাহা ঐ গানে সুর করছিলেন এবং গানগুলো শুভমিতা ব্যানার্জী, রাঘব চ্যাটার্জী, রূপঙ্কর বাগচীসহ অপরাপর কণ্ঠশিল্পীরা গানে কণ্ঠ দিচ্ছিলেন। আমি গান লেখার চেয়ে কবিতাই বেশি লিখেছি এবং ঐ সময়েও লিখছিলাম। ফেসবুকে কবিতার পোষ্ট দিতাম। ফেসবুক বন্ধু হওয়ায় কুন্দন সাহা একদিন বললেন, আপনি তো খুব সুন্দর কবিতা লিখেন। কবিতা আবৃত্তি করাবেন? ২০১২ সালে আমার লেখা কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রজ্ঞা লাবণী। এটিএন মিউজিক থেকে এই আবৃত্তি বের হয়েছিল-আকাশ আয়না, শিরোনমে নামে। কলকাতায় কে আবৃত্তি করবেন-জানতে চাইলে কুন্দন সাহা বলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে আপনার কবিতা পাঠাতে পারি। তিনি যদি কবিতা পছন্দ করেন এবং আবৃত্তি করতে রাজী হন, তাহলে হতে পারে। প্রস্তাবটি অনেক আকর্ষণীয় হলেও আমি অনেকদিন এ নিয়ে কিছু ভাবিনি। কেন এমন প্রস্তাবকে গুরুত্ব দিইনি, এটা আজো নিজের কাছে বিস্ময়কর লাগে। প্রায় একবছর পর নিউইয়র্কে কয়েকজন শুভানুধ্যায়ীর সঙ্গে এ বিষয়টি আলাপ করলে তারা বিস্মিত হন-কেন আমি এখনও কাজটি করার উদ্যোগ নেইনি-এই প্রশ্নে। তারা আমাকে উৎসাহিত করেন এবং আমি কুন্দন সাহাকে কাজটি করার কথা জানাই। ২০১৭ সালে আমার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ-বসন্ত নয় অবহেলা বের হয় একুশের বইমেলায়। এই গ্রন্থ থেকে ২০টি কবিতা নিয়ে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করি। কবিতাগুলোর অধিকাংশ ছিল পুরুষ কণ্ঠের এবং কয়েকটি দ্বৈত-কণ্ঠে আবৃত্তির জন্য। কুন্দন সাহা’র সঙ্গে আবৃত্তি শিল্পী মধুমিতা বসুর সু-সম্পর্ক এবং মধুমিতা বসু’র সঙ্গে সু-সম্পর্ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মধুমিতা বসু দ্বৈতভাবে কণ্ঠ দেবেন মধুমিতা বসু-সিদ্ধান্ত হয়। পাণ্ডুলিপি পাঠ করে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় রাজী হন। তবে ২০টি নয়, ১২টি কবিতা আবৃত্তি করবেন বলে তিনি জানান। ঠিক ঐ সময়কালে নাট্যকার ও উপন্যাসিক (আমার ঘনিষ্ঠজন) কলকাতায় গেলেন। আমি সাঈদ তারেককে এই আবৃত্তির সার্বিক বিষয়টি তত্বাবধান করার অনুরোধ করি। তিনি রাজী হন। ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার একটি রেকর্ডিং স্টুডিওতে আবৃত্তি রেকর্ড হলো। আমার মধ্যে সেকী টানটান উত্তেজনা আর তুমুল আনন্দের শিহরণ! কলকাতায় যখন আবৃত্তি রেকর্ড হচ্ছিলো, তখন আমার নিউইয়র্কে রাত। গভীর রাত অব্দি আমি জেগে ছিলাম। কবিতা আবৃত্তি করার সময় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ১২টির পরিবর্তে ২০টি কবিতা আবৃত্তি করে ফেলেন। সহ-শিল্পী মধুমিতা বসু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি ১২টি কবিতা আবৃত্তি করবেন-বলেছিলেন। জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘ছেলেটা ভালো কবিতা লিখেছে, চলো, পড়ে ফেলি!’ কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে কিছু শব্দের ব্যবহার ও ব্যাঞ্জণা নিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কথা বলেছেন সাঈদ তারেকের সঙ্গে। বাংলাদেশ ও কলকাতায় ব্যবহৃত বাংলা শব্দ ব্যবহার ও ব্যাঞ্জণার প্রকাশ নিয়ে তারা দু’জন আলাপ-আলোচনা করেন। কারণ, এমন বেশ কিছু শব্দ ও ব্যাঞ্জণা আমার কবিতায় ছিল। আবৃত্তিতে কণ্ঠের প্রক্ষেপণ সঠিক হওয়ার ক্ষেত্রে শব্দ ও ব্যাঞ্জণার আলোকপাতে সাঈদ তারেক সহযোগিতা করেছেন সেদিন। এদিন রাতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলিয়ে দেন কুন্দন সাহা। কবিতাগুলো নিয়ে কথা হয় এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কলকাতায় গেলে তাঁর বাড়িতে যাবার নিমন্ত্রণ করেন। আমি নিউইর্য়কে আসার কথা বললে তিনি এই বয়সে ওড়োজাহাজে যাতায়াত করতে পারবেন বলে জানান। তাঁর কথাবার্তা ছিল খুব আন্তরিকতাপূর্ণ এবং অমায়িক। খুব ইচ্ছে ছিল কলকাতায় গিয়ে এই বরেণ্য অভিনেতার সঙ্গে দেখা করব। তা সম্ভব হয়নি। ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আরো কিছু কবিতাসহ আগের কবিতাগুলো ক্যামেরার সামনে পুনরায় আবৃত্তি করেন। এ ছাড়া আরো নতুন ১৭টি কবিতা আবৃত্তি করানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে এবং দেহত্যাগ করায় তা আর হয়নি। এই প্রাজ্ঞজন অভিনেতা, আবৃত্তিকার, সম্পাদক ও কবি আমার কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন বলে তাঁর প্রতি আমার অসীম কৃতজ্ঞতা। তাঁর সান্নিধ্য পেলাম না বা দেখা হলো না বলে বিব্রতকর অতৃপ্তি আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে সমসময়। পরিশেষে, তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং মধুমিতা বসু’র আবৃত্তি করা কবিতাগুলো কলকাতায় ইউডি এন্টারটেন্টমেন্ট প্রা. লি. থেকে অন-লাইনে প্রকাশিত ২০১৮ সালের ৬ অক্টোবর। এই কবিতাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত কবিতা হচ্ছে-বসন্ত নয় অবহেলা-কবিতাটি। এটি বাংলা ভাষাভাষী কবিতাপ্রেমিদের কাছে জনপ্রিয় কবিতায় পরিণত হয়। খুব দ্রুত তা পৌঁছে যায় কাব্যপ্রেমিদের কাছে। ২০১৭ সালে এই কবিতাটি নিউইয়র্কে প্রথম আলো’ উত্তরামেরিকা’র জ্যামাইকাস্থ অফিসে আমি প্রথম শোনাই কথা সাহিত্যিক, কবি ও সাংবাদিক আনিসুল হককে। কবিতাটির আবৃত্তি শোনার পর আনিসুল হক উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে প্রশংসা করেন এবং বলেন, তোমার সঙ্গে একটা ছবি তুলি রাখি। একজনকে ডেকে তাঁর সেলফোন ক্যামেরায় একটি ছবিও তোলেন। আমি রসিকতা মনে করে নিই। কিন্তু কে জানতো, আনিসুল হকের কথাটি যেন পরবর্তীতে সত্যি হয়ে যায়! বসন্ত নয় অবহেলা-কবিতাটি অন-লাইনে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে আনিসুল হক-(২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর) আমার এ সংক্রান্ত এক পোস্টে লিখেছেন- ‘কবিতাটি এখন বিশ্ববাসীর সম্পদ।’ ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরপরই এই কবিতাটি পোস্ট দিয়ে বিভিন্ন স্যোসাল মিডিয়ায় ভক্তরা তাঁর মৃত্যুর সংবাদ জানান।
বসন্ত নয় অবহেলা
[সৌমিত্র চট্টোপাধ্যয় যে কবিতা আবৃতি করেছিলেন; তার একটি]