সাহিত্যের সবচেয়ে আকর্ষণীয় মাধ্যম হচ্ছে কবিতা। কবিতায় যখন ‘মানব জীবন’ আখ্যানের নানা দিক ভাষাশৈলীতে প্রকাশিত হয়, তখন তা পাঠকের মনকে আবিষ্টতায় ডুবিয়ে দেয়। এই বিবেচনা বা দৃষ্টিভঙ্গিতে কবি দর্পণ কবীরের কাব্যগ্রন্থ-‘মিথ্যাগুলোর নন্দন মুখশ্রী’ নিয়ে আলোচনা করছি।
সাংবাদিক, লেখক, গীতিকার এবং কবি এই পরিচয়ে দর্পণ কবীর সাহিতাঙ্গনের অনেকেরই চেনা। যখন আমি কবিকে চিনি না, তারও আগে পরিচিত হয়েছিলাম তাঁর কবিতার সঙ্গে। সামাজিক ফেসবুকের পাতায় ভেসে আসছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্বকন্ঠ আবৃত্তি ‘বসন্ত নয়, অবহেলা’ কবিতাটি। মুগ্ধ হয়ে শুনেছি অনেকবার। শুনতে শুনতে মনে হতো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কবিতায় যেন নিজের কথা বলে যাচ্ছেন। সে কী আবৃত্তি! তারপর এই কবির আরো কবিতার সঙ্গে পরিচিত হই। এবং একদিন আলাপ হয় সদালাপী এই কবির সঙ্গেও। রোমান্টিক কবিতা লেখেন দর্পণ কবীর। রোমান্টিক কবিতা ও গল্প লিখে তিনি নিজের স্থান করে নিচ্ছেন-এ কথা বলা যায়।
‘মিথ্যাগুলোর নন্দন মুখশ্রী’ গ্রন্থটির প্রচ্ছদের মতোই কবিতাগুলো পাঠ করলে অনুভবের ভেতরে তন্ময়তার ভার সৃষ্টি করে, যা পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেয় নদীর পাড়ের নিঃসঙ্গ বিরহের এক খোলা মাঠে। যেখানে বৃদ্ধ বটবৃক্ষের মসৃণ ছায়া নেই। তবে পদতলে আছে কার্পেটের মতো সবুজ ঘাস। যেখান থেকে নদীর শান্ত জলে কেবলমাত্র একাকিত্বের প্রতিকৃতি চোখে পড়ে। চোখে পড়ে প্রেম- মায়া-আনন্দ–বিরহ—আর ভালোবাসা। বইটির নামকরণ কবিতায় রোমান্টিকতা উৎরিয়ে প্রকৃতি দুষণে অভিমানের প্রসঙ্গ সামাজিক দায়বোধের ক্ষেত্র প্রতিভূত। আছে নির্মোহ অভিব্যক্তি ‘আমাদের কান্নার কোনও দাবি নেই, প্রত্যাশা নেই’। কবিতার বোধে একজন মানুষকে প্রত্যাশা করেছেন প্রকৃতির মত ‘খোলা বইয়ের মতো আমার সামনে এসে দাঁড়াবে, আমি মনযোগী পাঠক হবো’। আহা কবি যেন মানুষ হয়ে এমনি মানুষকে ভালোবেসে হতে চেয়েছেন দুঃসাহসিক একজন ঈশ্বরের কবি! এছাড়াও বইয়ের অনেক কবিতার ভেতর যে সব পংক্তিগুলো ছুঁয়ে যায়-‘এসো জীবন বসন্তের পত্রপল্লব ছিঁড়ে দেখে নেই শূন্য হাত কতটা নির্মোহ’ অথবা ‘আনন্দ আসে দমকা হাওয়ার মতো। কিন্তু বিষণ্ণ মুখের ভিড়ে আমিও যে, বিষাদগ্রস্ত পথিক! দুঃখের পুঁথি পাঠ করে সময় চলে যায়’, পড়ে পড়ে বিষন্ন পুঁথি পাঠের শব্দ পাই রাতের দ্বিতীয় প্রহরের অমাবস্যায় প্রদীপের ম্লান আলোয় অথবা জ্যোৎস্নায়। আগ্নেয়গিরির ভেতর বা ‘মহাকাশে খুঁজে পাওয়া দীর্ঘশ্বাস’ প্রেম হয়ে ফিরে আসে হৃদয়ের জমিনে আবার। ‘কিছু দুঃখ রোদের পিঠে মেঘ হয়, কিছু কথা বৃষ্টি’ কবিতার ভেতর থেকে উঠে এসে যেন নির্দ্বিধায় ‘শোকের স্বরলিপিতে কন্ঠ মেলাই’। কবির ‘সত্য স্বীকার’ কবিতায় ‘আকাশটাকে রুমালের মতো ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিতে পারলে তোমাকে আর নক্ষত্রের গান শোনানোর প্রতিশ্রুতি দিতাম না।’ লাইনটি ভাবুলতায় ডুবিয়ে দেয় অনায়াসে।
কবিতার নামকরণেও কবির মুন্সিয়ানা আছে। যেমন ‘বিলাসী গাঙচিল’, ‘নদীর গল্প’, ‘জুঁই ফুলের দুঃখ’। ’জুঁই ফুলের দুঃখ’তে ’জোড়া শালিকের খুনসুটি’ এক দারুণ শব্দযুগল। ‘কাব্যকথন’ এ নারী ও পুরুষের কথোপকথনে বেহুলার ভেলা ভাসে অবশেষে। ‘হলুদ শার্টের নিরুদ্দেশ বোতাম’ কবিতাটি যেন এক বিবর্ণ অতীতের ছবি আঁকে চোখে। মনে পড়ে যায় তারুণ্যের দিনগুলো। তেমনি কবির কবিতায় ‘দেয়াল ভাঙে’ আর ঈশ্বরের ধ্যান ভাঙে। পাঠকের মগ্নতা ভাঙে না শেষ অবধি। ’বসন্ত নয় অবহেলা’ কবিতায় নুইয়ে পড়া ভালোবাসায় জীবন আখ্যানের স্বগোক্তি ‘ আমি জানি, এই দীর্ঘশ্বাসে ভরা এই আখ্যান যদি পেত কবিতার রূপ, সেই অবহেলা হতো বসন্ত স্বরূপ’ কবিতাপ্রেমীদের অনুভবে অন্তর্গত দুঃখ, কষ্ট বা হাহাকারকে পারিজাত রূপ দিতে সাহায্য করে। এছাড়াও কবিতাটির ভেতর খুঁজে পাওয়া যায় অব্যক্ত অনুভূতির নিপাট মানবিক অভিমানের ভাষা, বিষণ্ণতা আর মধ্যাহ্নের নিঃসঙ্গতা। জীবনের এই পথ পরিক্রমায় রক্তাক্ত অধ্যায়ের আন্তরিক নির্যাস, কবিতা প্রেমিকদের আকৃষ্ট করবে সন্দেহ নেই। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন স্বনামখ্যাত শিল্পী সব্যসাচী হাজরা। এই কাব্যগ্রন্থটি বের হয়েছে একুশের বইমেলায় ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, অনুস্বর পাবলিকেশন্স থেকে।