নিউইয়র্কে জলপ্রপাত উপন্যাস-এর প্রকাশনা উৎসব হয়েছিল

page 2

নিউইয়র্কে ২০১০ সালের ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় এস্টোরিয়ার ক্লাব সনম মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল লেখক ও সাংবাদিক দর্পণ কবীর এর উপন্যাস ‘জলপ্রপাত’ এর প্রকাশনা উৎসব। এই উৎসব-অনুষ্ঠানে আলোচক ছিলেন তৎকালীন সময়ের জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের কালচারাল মিনিস্টার ও বিশিষ্ট নাট্যজন (প্রয়াত) অধ্যাপক মমতাজ উদদীন আহমদ, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ড. পূরবী বসু, বিশিষ্ট সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহসহ নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকগণ।
অনুষ্ঠানে আলোচকরা জলপ্রপাত উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করেন। মার্কিন সমাজে অভিবাসী জীবনে যেমন টানাপোড়েন আছে, তেমনি আছে ঘাত-প্রতিঘাত-অভিঘাত, সংঘাত এবং সময়ের সঙ্গে দ্রুত চলা ও কর্মব্যস্ততা। আছে স্বপ্ন দেখার অনুরণন, স্বপ্ন ভাঙ্গার বেদনাও। আছে কপটতা, প্রতারনা, কমিউনিটিতে নেতার হবার অসুস্থ প্রতিযোগিতা, ঝগড়া-বিবাদ-কোন্দল। আবার আছে মানবিকতা, পরস্পর পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টি-সৌহার্দ্য ও মমত্ববোধ এবং জীবনের মহত্বও এখানে প্রতিফলিত হয় নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে। এসবের মধ্য দিয়ে প্রবাসে আমাদের অভিবাসী জীবন নানা ঘটনায় এগিয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে যারা লিখছেন বা সাহিত্যকর্মে নিয়োজিত রয়েছেন, তারা দ্বৈত সত্ত্বা নিয়ে কাজ করছেন। এক সত্ত্বা সৃষ্টিশীলতায় নিমগ্ন, অন্য সত্ত্বা জীবন-জীবিকার সংঘাতে লড়াই করছে প্রতিনিয়ত। এ কথা উঠে এসেছিল আলোচকদের বক্তব্যে। তারপরও সাহিত্যে নিজের অবস্থান করে নিতে হলে প্রবাসের লেখকদের কথা সাহিত্যের নিজস্ব ভাষা শৈলী নির্মাণ প্রয়োজন বলে মন্তব্য করা হয়েছে। জলপ্রপাত উপন্যাসের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে নিরবচ্ছিন্ন ও প্রাণবন্ত আলোচনা উপভোগ করেছেন সমবেত সবাই।
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ বলেছিলেন, দর্পণ কবীর এর ‘জলপ্রপাত’ উপন্যাসটি পাঠ করে আমি আলোড়িত হয়েছি। এটি প্রেমের যন্ত্রণার, অবসন্নের চৈতন্যের একটি উপন্যাস। এই উপন্যাস এতো ব্যাঞ্জণাময় যে পাঠককে টেনে নিয়ে যায়। উপন্যাসটির পরিধি ছোট, তবে ছোট উপন্যাস হলেও সর্বশ্রেষ্ঠও হতে পারে। আমি দর্পণ কবীর এর উত্তরোত্তর সফলতা কামনা করছি। তিনি আরো বলেছিলেন, উপন্যাসটি আমার খুবই ভাল লেগেছে। উপন্যাসের গল্প বেদনার মূলে চলে গেছে। উপন্যাসটি পাঠককে ভাবাবে, স্পর্শ করবে বলে আমার বিশ্বাস। আমি দর্পণ কবীরকে অভিনন্দন জানাচ্ছি এই উপন্যাস লেখার জন্য।
ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত বলেছিলেন, জলপ্রপাত একটি প্রেমের উপন্যাস হলেও লেখক এই উপন্যাসে জীবন সংগ্রামের কথাও বলার চেষ্টা করেছেন। লেখককে ভবিষ্যতে ইংরেজী ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরো সচেতন হতে হবে। তিনি আরো বলেন, দর্পণ কবীর আমার ঈর্ষার পাত্র। আমি অনেক বছর ধরে চেষ্টা করছি উপন্যাস লেখার। কিন্তু পারছি না। হুমায়ুন আহমেদও আমার ঈর্ষার পাত্র। তিনি বলেন, জলপ্রপাত উপন্যাস আকারে ছোট হয়েছে। তবে উপন্যাস যে আকারে বড় হতে হবে-তা আবার বিশ্বাস করিনা। এই উপন্যাসে লেখক অভিবাসী জীবন সংগ্রামের কথা বলার চেষ্টা করেছেন। জলের উৎসের কাছে গিয়েও জল না পাবার কথা উপন্যাসে ফুটে উঠেছে। এখানে লেখক নায়াগ্রার জলপ্রপাতকে প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করেছেন। কার্যত অভিবাসী জীবনকে জলপ্রপাত এর সঙ্গে লেখক তুলনা করেছেন।
ড. পূরবী দত্ত বলেছেন, দর্পণ কবীরের লেখা সুখপাঠ্য। তার লেখা পাঠককে টেনে নিয়ে যায়। উপন্যাসের চরিত্রগুলো জীবন্ত, পরিণত। তবে উপন্যাসে প্রথম প্রজন্মের সামাজিক টানাপোড়েন ফুটে উঠলে ভাল হত। নর-নারীর মধ্যে প্রেমের সম্পর্কের চেয়ে শক্তিশালী কিছু নেই। এই উপন্যাসে তা বিধৃত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, উপন্যাসে চরিত্রগুলোর ব্যাকগ্রাউন্ড থাকলে ভাল লাগত। দর্পণ কবীর একজন প্রতিশ্রুতিবান লেখক বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ বলেছিলেন, আমাদের প্রবাসের অবক্ষয়, নেতা হবার অসুস্থ প্রতিযোগিতা, ফোবানা নামক ফানুস ইত্যাদি ঘটনা সৃজনশীল সাহিত্যে উঠা আসা দরকার।
বাঙালী পত্রিকার সম্পাদক কৌশিক আহমেদ বলেছিলেন, দর্পণ কবীরের গল্পলেখার ক্ষমতা আছে। জলপ্রপাত উপন্যাসটি ঝরঝরে ভাষায় লেখা উপন্যাস। এটি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়। তিনি আরো বলেন, লেখক গল্প বলতে জানেন, তিনি সাজিয়ে তা বলতে পারেন। উপন্যাসটি শুরু করলে শেষ করতে হবে। উপন্যাসের শুরুটা চমৎকার, টেনে নিয়ে যায়। আকর্ষণ তৈরি করে শেষ পর্যন্ত যাওয়ার। তবে এই উপন্যাসে চরিত্রগুলোর জীবিকার কথা দেখিনা। লেখক প্রতিটি অধ্যায়ে তার ক্ষমতা দেখিয়েছেন, কিন্ত জীবন সংগ্রাম দেখাননি। উপন্যাসে বাংলাদেশকে পাইনি। ভবিষ্যতে লেখক এই বিষয়গুলো মাথায় রাখবেন বলে আশা করি।
সাপ্তাহিক পরিচয় সম্পাদক নাজমুল আহসান বলেছিলেন, জলপ্রপাত উপন্যাসটির গল্প দ্রুত শেষ হয়ে গেছে। চরিত্রগুলোর আরো ব্যাপ্তি দরকার ছিল।
কবি সৈয়দ কামরুল বলেছিলেন, দর্পণ কবীর দুটো দুরূহ কাজ একসঙ্গে করছেন। তিনি সাংবাদিকতাও করছেন, আবার সাহিত্য চর্চাও করছেন। ছড়া, কবিতা, গল্প বা উপন্যাসের প্রত্যেকটির ভাষা শৈলী ভিন্ন। সাংবাদিকতার ভাষাও ভিন্ন। দর্পণ কবীর একইসঙ্গে এই কাজগুলো কীভাবে করছেন, তা আমাকে বিস্মিত করে। তিনি আমার কাছে একজন ঈর্ষণীয় তরুণ। তিনি আরো বলেন, কথাসাহিত্যের নিজস্ব ভাষা শৈলী নির্মাণ করতে হবে এই লেখককে। নিজস্ব ভাষা শৈলী তৈরি করতে পারলেই একজন লেখক টিকে থাকতে পারেন।
বাংলা পত্রিকার সম্পাদক আবু তাহের বলেছিলেন, দর্পণ কবীর একজন আপোসহীন সাংবাদিক। তিনি সাংবাদিক বলেই তার সাহিত্য চর্চায় সমাজের অসঙ্গতি-অনিয়ম ফুটে উঠবে। সাংবাদিকের অনুসন্ধানী চোখে তিনি যা দেখেন, তা-ই তার লেখার উপজীব্য বিষয় হবে-এটা বলতে পারি। তিনি সাহিত্য চর্চায় আমাদের সমাজকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করবেন-এই আশা রাখি।

Facebook
Twitter
LinkedIn
Pinterest

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *